ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস

ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস
ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ। দুই পক্ষ বছরের পর বছর ধরে লড়াই করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি। গাজার চলমান সংঘাত যদি অন্য সব যুদ্ধের মতো হতো, তাহলে এখন অনেক কিছুই অন্যরকম দেখা যেত।


সম্প্রতি যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তবে অন্য কোথাও এ ধরনের সংঘর্ষ হলে হয়তো অনেক আগেই এই যুদ্ধবিরতি শুরু হয়ে যেত। মৃতদের কবর দেওয়া হত এবং গাজা পুনর্গঠনের জন্য ঠিক কতটা প্রয়োজন তা নিয়ে ইসরায়েলকে জাতিসংঘের সাথে তর্ক করতে হতে পারে। কিন্তু এ যুদ্ধ তাদের মতো নয়। কারণ এখানে যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে তা একমাত্র কারণ নয়।


নতুন করে এখানে সংঘাত শুরু হয় গত ৭ অক্টোবর। সেদিন ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপরেই গাজায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল যাকে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অভিহিত করেছেন ‘ভয়ংকর প্রতিশোধ’ হিসেবে। সেখানে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে।


এই যুদ্ধ অন্যদের থেকে আলাদা কারণ এটি এমন এক সময়ে আসে যখন মধ্যপ্রাচ্যকে বিভক্তকারী ফল্ট লাইনে ফাটল ধরে। গত দুই দশক ধরে এখানে ভূ-রাজনীতির উত্তেজনাপূর্ণ চিত্র একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা।


ইরানের এই নেটওয়ার্কের মূলে যেটা কখনো পরিচিত ‘প্রতিরোধের জোট’ হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে।


একই সঙ্গে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে।


গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরায়েল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে, ততই এই দুই মিত্র গোষ্ঠীর কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে।


ইসরায়েল ও লেবাননের সীমান্তে ধীরে ধীরে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ কেউই সরাসরি যুদ্ধ চায় না। কিন্তু উত্তেজনা দুই দিক থেকেই বেড়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।


ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের দিকে মিসাইল ও ড্রোন হামলা করছে। সে সবগুলোই অবশ্য প্রতিহত করেছে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেড সিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর।


অপরদিকে ইরাকে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের কিছু অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যদিও সবপক্ষই উত্তেজনা যাতে খুব বেশি না ছড়ায় সেই চেষ্টা করছে, কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সবসময়ই কঠিন।


যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে ইসরাইল, উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্র, জর্ডান ও মিশর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার শুরু থেকেই ইসরায়েলের শক্তিশালী সমর্থক, যদিও এটা স্পষ্ট যে এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনি বেসামরিক হত্যাকাণ্ডে অস্বস্তি বোধ করছেন।


মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন প্রকাশ্যে বলেছেন যে অনেক ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজা থেকে পালিয়ে যাওয়ার এবং প্রধান রাস্তা ধরে দক্ষিণে হাঁটার দৃশ্য আরবদের বিরুদ্ধে 1948 সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইসরাইলের বিজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।


যে সাত লাখেরও বেশি মানুষ ইসরায়েলি বাহিনীর অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে সেটাকে ফিলিস্তিনিরা আল নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। ১৯৪৮ সালের শরণার্থীদের পরের প্রজন্মের বেশিরভাগই এখন গাজা উপত্যকার বাসিন্দা।


আর কিছু উগ্র ইহুদী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক। তাদের অনেকের ফিলিস্তিনিদের ওপর আরেকটি নাকবা আরোপের মতো ভয়ংকর কথাবার্তা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শিবিরেরই কিছু আরব দেশ বিশেষ করে জর্ডান ও মিশরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।


এমনকি নেতানিয়াহু সরকারের একজন মন্ত্রী হামাসকে মোকাবেলা করার জন্য গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাকে তিরস্কার করা হলেও বহিষ্কার করা হয়নি।


এসবকে পাগলের আলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু জর্ডান ও মিশর বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছে। সেটা অবশ্য পারমাণবিক বোমার ব্যাপারে না হলেও যেটা ইসরায়েলের ঘোষিত ও অঘোষিত অনেকেই আছে। বরং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের সীমান্তে প্রবেশের আশঙ্কা করছে।


এবং যদি গাজায় যুদ্ধের কথা বলা হয়, বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সিনিয়র কূটনীতিকরা বলছেন যে যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা খুবই 'কঠিন এবং বিশৃঙ্খল' হবে।


একজন বলেছেন, একমাত্র রাস্তা হবে ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুনর্নির্মাণ করা। তিনি মূলত ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তথাকথিত দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ব্যর্থ হয়ে এখন শুধু স্লোগানেই টিকে আছে।


সেটাকেই পুনরুজ্জীবিত করা, ইসরায়েল ও আরবের মধ্য থেকে তাদের জায়গা বের করা খুবই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা এবং একই সঙ্গে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো সমাধানও।


কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ। আর বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব তাদের অধীনে এটা অসম্ভব।


প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধ সমাপ্তির পর কি হবে সেই পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ করেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রস্তাব সেখানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকার সমর্থিত একটি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।


যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হলো দ্বী-রাষ্ট্র সমাধান নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, যেটা নেতানিয়াহু তার পুরো রাজনৈতিক জীবন জুড়ে বিরোধিতা করে আসছেন।


ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বিপক্ষে শুধু নেতানিয়াহুই নন। তিনি যাদের সমর্থনে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন সেই গোঁড়া ইহুদী জাতীয়তাবাদী যারা তাদের বিশ্বাস, জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মাঝখানের যে অঞ্চল সেটা পুরোটাই ইহুদীদের জন্য ঈশ্বরের দান এবং তা ইসরায়েলের সীমানার ভেতরেই থাকতে হবে।


ইসরায়েলের ভেতরে অনেকেই গত ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতায় নেতানিয়াহুকে দায়ী করে তার পদত্যাগ চান। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে, ভোটারদের কাছেও তার সমর্থন এখন কম। যদিও ২০০৫ সাল থেকেই তিনি ব্যালট বাক্স ছাড়াই ক্ষমতায় রয়েছেন।


ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েলকে সহায়তা করে আসছে কিন্তু তাদের নিজেদের লোকদেরই বসতি স্থাপনকারী অস্ত্রধারী ইহুদীদের থেকে রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। একসময় নেতৃত্বের বদল ঘটবে। কিন্তু যদি গাজার এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও তাদের শক্তিশালী বন্ধুদের শান্তি স্থাপনে বাধ্য না করে তাহলে ভবিষ্যতে আরো যুদ্ধই অপেক্ষা করছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url